আজকাল অনেকেই দাড়ি রাখেন। কারণ, এটাই এখন হট ফ্যাশন! ক্রিকেটার, অভিনেতা— সকলেই রাখছেন মুখভর্তি দাড়ি। আর দেখাদেখি এদের ভক্তকূলও দাড়ি রাখতে ব্যাকুল!
555555555
কিন্তু মেয়েরা কি শুধু ‘দাড়িওয়ালা’ সেলেবদেরকেই পছন্দ করেন? নাকি ‘আম’ যুবকদেরও দাড়িতেই বেশি পছন্দ করেন? এই সঠিক উত্তর না জানা থাকলে, বা বেশির ভাগ মেয়েদের পছন্দের সঠিক খবর না জানা থাকলে দাড়ি রাখাটাই সার হবে। তবে চিন্তার কিছু নেই! সম্প্রতি এর উত্তর খুঁজতে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিলেন কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। তাদের এই সমীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন সাড়ে আট হাজারেরও বেশি মহিলা।
অংশগ্রহণকারীদের প্রত্যেকের কাছেই তাদের পছন্দ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। এই সমীক্ষায় তাদের থেকে জানতে চাওয়া হয়, কেমন পুরুষ সঙ্গী তাদের পছন্দ, দাড়ি-গোঁফওয়ালা নাকি ‘ক্লিন শেভড’! অদ্ভুতভাবেই ৬০ শতাংশেরও বেশি অংশগ্রহণকারী মহিলা জানান, দাড়ি-গোঁফওয়ালা পুরুষ সঙ্গীই তাদের বেশি পছন্দ। শুধু তাই নয়, এদের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশের মত, হালকা ট্রিম করা দাড়ি নয়, ঘন দাড়ি-গোঁফেই তারা ছেলেদের বেশি পছন্দ করেন।
সম্প্রতি রংপুর মহানগরীর বিভিন্ন সড়কে দেখা গেলো যানবাহনে পায়ে হাঁটা বহু নারীর মাথায় হিজাব। সর্বাধুনিক ডিজাইনের বাহারি রঙয়ের হিজাবে সকল বয়সী নারীর মুগ্ধ পদচারণা। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আড্ডারত দুই তরুণীর কাছে মাথায় হিজাবের আধিকত্য জানতে চাইলে তারা জানালেন মাথার চুল আবৃত করতেই হিজাব পরি। এটা এখন আমার ফ্যাশন। একদিকে চুলও আবৃত করা হলো, চুলও ধুলোবালি থেকে রেহাই পেল, ধর্মীয় অনুশাসনও মানা হলো, অন্যদিকে আধুনিক ফ্যাশনও করা হলো। হিজাব পরলে নিজেদের বেশি আকর্ষণীয় মনে হয় বলেও সাফ জবাব ছিল তাদের। তবে ১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব হিজাব দিবস সম্পর্কে কিছু জানা নেই তাদের। বস্তুত নানা রঙয়ের নানা ডিজাইনের হিজাবে আবৃত মাথা নারীদের ফ্যাশনে এনে দিয়েছে এখন ভিন্নমাত্রার নান্দনিকতা। নারী পোশাকে এই বৈপ্লবিক পরিবর্তন আবহমান বাংলার চিরায়ত সাংস্কৃতিতে এনে দিয়েছে বহুমাত্রিকতা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, হিজাবকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য এবং পর্দার ব্যাপারে ইসলামী বিধান অনুসরণকারী সব মুসলিম নারীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য প্রতিবছর ১ ফ্রেব্রুয়ারি পালিত হচ্ছে বিশ্ব হিজাব দিবস। এবারের হিজাব দিবসের স্লোগান ‘হিজাব ইজ মাই ফ্রিডম, হিজাব ইজ মাই প্রটেকশন, হিজাব ইজ মাই চয়েস, হিজাব ইজ মাই কভার।’ কয়েক বছর আগে আমেরিকার নিউইয়র্ক সিটিতে নাজমা খান নামক এক বাংলাদেশী ছাত্রী পোশাকের কারণে জ্যামাইকায় হেনস্থ হন। ওই ঘটনার প্রতিবাদ, নিন্দা এবং সর্বসাধারণকে সচেতন করার জন্য গত ছয় বছর থেকে আমেরিকায় হিজাব দিবস পালন শুরু হয়।
রংপুর মহানগরীসহ এখন সারাদেশে সব বয়সি নারীরাই এখন নানা রঙয়ের শাড়ি কিংবা জামার সাথে মাথায় বাহারি ডিজাইন ও রঙয়ের হিজাব ব্যবহার করছেন। ১ ফ্রেব্রুয়ারি হিজাব দিবসে এটি জানান দিলো কিভাবে বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতিতে হিজাব অবশ্যাম্ভারী নান্দনিক ফ্যাশন হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। হিজাব দিবসের সাথে ইতোমধ্যে সংহতি প্রকাশ করেছেন ৪৫টি দেশের ৭০ জনের অধিক রাষ্ট্রদূত, খ্যাতনামা রাজনীতিক ও স্কলারসহ টাইম ম্যাগাজিন, সিএনএনের মতো বিশ্বখ্যাত গণমাধ্যম। ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে ওয়ার্ল্ড হিজাবডে ডট কম পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, শতকরা ৯৪ ভাগ নারী হিজাবে নিজেদেরকে নিপীড়িত মনে করেন না। শতকরা ৯৩ ভাগ নারী মনে করেন তাদের ওপর হিজাব চাপিয়ে দেয়া হয়নি।
বাংলাদেশে গত পাঁচ বছর থেকে ফ্যাশনে নারীদের হিজাবের দিকে আকৃষ্ট হওয়ার মাত্রা বেড়ে গেছে বহুগুণ। একসময় বাংলাদেশের রাস্তায় পাশ্চাত্যের আদলে শর্ট কামিজ, খোলামেলা পোশাক পরিধানের যে ধুম লেগেছিল তা থেকে এখন বেরিয়ে আসছেন নারীরা। বাংলাদেশের দিন আনা দিন খাওয়া পরিবার থেকে অঢেল বিত্তবৈভবে বেড়ে উঠা নারীরাও হিজাবকেই ফ্যাশন হিসেবে গ্রহণ করছেন। স্কুল মাদরাসা থেকে শুরু করে সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল ধরনের বিদ্যাপিঠের নারী শিক্ষার্থীরা হিজাবকেই প্রথম পছন্দের ফ্যাশন হিসেবে গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করছে।
বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানে জানা গেলো নানান কথা। হিজাব শুধু নান্দনিক ফ্যাশনই নয়, এটি নারীদের মর্যাদাকেও বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে হিজাবের রীতিমত বিপ্লব ঘটে গেছে। শাড়ি, জামার সাথে হিজাব পরে কর্মক্ষেত্রসহ সকল ক্ষেত্রে নারীদের সরব উপস্থিতি তাদের আভিজাত্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। প্রাচীন বাংলার জনগণ যখন ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তখন তারা দেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি টিকিয়ে রেখে যা করেছিলেন হালের নারীরাও তা আবার ফিরিয়ে আনছেন। যে দেশের নারীরা বেশি বোরকা কিংবা হিজাব পরবেন তারা অধিকতর ডান, গোঁড়া বা রক্ষণশীল বলে কথিত যে বুলি আওড়ানো হচ্ছিল একবিংশ শতাব্দিতে। বাংলাদেশের নারীরা সেই কথিত বুলিকে চপেটাঘাত করে পোশাকের ফ্যাশনে হিজাবকে নান্দকিভাবে উপস্থাপন করেছেন।
বাংলাদেশে নারীদের এই হিজাব বিপ্লব রাষ্ট্রীয় বা আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে নৈতিকতার বড় ধরনের মাইলফলক এনে দিয়েছে। রাজনীতি থেকে রান্নাঘর। সবখানেই তাই হিজাবের জয়জয়কার। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হিজাব পরিহিত মীর্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাসের নির্বাচনী প্রচারণা মানুষের নান্দনিক সৌন্ধর্য সমীহকে ভিন্নমাত্রা এনে দিয়েছে। টিভি সেটের সামনে বসা দর্শকদের মন্তব্য থেকে তা প্রতিয়মান।
সংবাদ ৭১
শুধু তাই নয়, হিজাব এখন এতটাই নারীদের কাছে গ্রহণযোগ্য ফ্যাশনেবল পোশাক হিসেবে স্থান পেয়েছে। যে বাংলাদেশের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যের প্রচারেও মডেল হিসেবে হিজাব পরিহিতা নারীকে বেছে নিয়েছে। বহুজাতিক কোম্পানির সেই শ্যাম্পুর মডেলের সেই হিজাব পরিহিতা নারীকে এখন টিভি, পত্র পত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিলবোর্ডসহ সবখানেই দেখা যায়।
জানতে চাইলে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন অনার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী মাসুমা আখতার নদী নয়া দিগন্তকে জানান, জাতি হিসেবে মুসলিমরা সেরা। তাই তাদের ফ্যাশনের নান্দনিকতাও ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে সেরা হওয়া উচিত। এখন তাই আমরা মুসলিম নারীরা শালীন পোশাকের সাথে হিজাব ব্যবহার করে বিশ্বের সর্বাধুনিক নারী হিসেবে উপস্থাপিত হচ্ছি। তাই আমরা মুসলিম নারীরা শাড়ি ও জামার সাথে হিজাব পরে সকল উৎবকে নান্দনিক করে তুলেছি। এর মাধ্যমে ইসলামের প্রগতিশীলতা আমরা রিপ্রেজেন্ট করছি।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী লুবনা হক জানালেন, মুসলিম নারীদের যারা কথিত গোড়া রক্ষণশীল বলে গালমন্দ করার চেষ্টা করে থাকেন মুসলিম নারীরা সর্বাধুনিক হিজাব পরিধান করে বড় বড় অনুষ্ঠানসহ সর্বক্ষত্রে প্রাণান্তকর উপস্থিতি এবং অংশগ্রহণ তাদের মুখে কুলুপ এটে দিয়েছে। এর মাধ্যমে ইসলাম যে নারীকে সবচেয়ে বেশি মর্যাদা দিয়েছে সেটি যেমন উচ্চকিত হয়েছে। ঠিক তেমনি আমরা সম্মানও পাচ্ছি। আমি যখন হিজাব পরিধান করে ক্যাম্পাসে কিংবা সকল ধরনের অনুষ্ঠানে সরবভাবে অংশগ্রহণ করি, সবাই আমাকে ভিন্নমাত্রায় রেসপেক্ট করে। এটা আমার ভালোলাগে।
রংপুর হোমিও কলেজের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মুমতাহিনা কাউছার নয়া দিগন্তকে জানান, প্রথমত হলো আমি একজন মুসলিম নারী হিসেবে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতেই হিজাব পরি। কিন্তু এর বাস্তব সুবিধা অনেক। যেমন একদিকে হালের সব চেয়ে ফ্যাশন হচ্ছে এই হিজাব। অন্যদিকে চলতে ফিরতে খারাপ মানসিকতার পুরুষদের বদনজর কুনজর থেকে রক্ষা করা যায়।
এছাড়াও হিজাব পড়া নারীদের চলতে ফিরতে সম্মান করে সবাই। কিন্তু খোলামেলাভাবে পোশাক পরলে মানুষ একটু অন্যভাবে দেখে। তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় উপকার হয় স্বাস্থ্যের। ধুলাবালী থেকে সেভ থাকা যায়। কারণ নারীদের ত্বক নরম। ধুলবালিতে দ্রুত ত্বক নষ্ট হয়ে যায়। বাড়তি পরিচর্যার দরকার হয়। কিন্ত হিজাবের কারণে চুল এবং ত্বক রক্ষা পায়। বাড়তি পরিচর্যার সময় বেঁচে যায়।
কারমাইকেল কলেজের ইসলামের ইতিহসের ছাত্রী ফারহানা আখতার নয়া দিগন্তকে জানান, কথিত খোলামেলা পোশাকের এই সময়ে নারীরা আমরা যে সর্বাধুনিক ফ্যাশন হিসেবে হিজাব ব্যবহার করছি, এটা খবুই তাৎপর্যপূর্ণ। এর মাধ্যমে মুসলিম নারী হিসেবে আধুনিক বিশ্বকে লিড দিতে পারছি আমরা। নিঃসন্দেহে এটা নারীদের নান্দনিক সৌন্ধর্যবোধকে বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে অনেকেই মাথায় হিজাব পরলেও বুকে একপাশে ওড়না ব্যবহার করেন এটা দৃষ্টিকটূ বলে মনে করেন তিনি।
জাতীয়ভাবে স্বীকৃত সেরা ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রংপুর ধাপসাতপাড়া মডেল কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ আনম হাদিউজ্জামান নয়া দিগন্তকে বলেন, নারীদের হিজাব পড়ার এই মানসিকতা একটি সভ্য সমাজ বিনির্মাণের জন্য ইতিবাচক দিক। এর মাধ্যমে নারীদের মধ্যে কথিত পাশ্চাত্য সভ্যতায় নারীদের যে শুধু ভোগের সামগ্রী হিসেবে চিহ্নিত করার কারণে খোলামেলাভাবে উপস্থাপন করা হয়। সেই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে নারীদের শালীন পোশাক পরিধানের মাধ্যমে মেয়েরা দাড়িওয়ালা ছেলেদের কতটা পছন্দ করে?
একটি পদক্ষেপ বাংলাদেশের নারীদের মধ্যে এখন নৈতিকতাবোধ সৃষ্টি হচ্ছে। তারা গড্ডালিকা প্রবাহে থাকতে চান না। এছাড়াও মানুষের মধ্যে এখন যে ধর্মই পালন করুক না কেন তার সেই ধর্মের অনুশাসন মেনে চলার আগ্রহ বেড়েছে। একটি মুসলিম প্রধান দেশে নারীদের এই হিজাব বিপ্লব একটি সভ্য সভ্যতা বিনির্মানে সহায়ক হবে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন স্টাডিজ সেন্টার সব থেকে প্রিয় পোশাক কী তা জানতে একটি সমীক্ষা করে। ২০১১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পরিচালিত সমীক্ষায় ৩২ শতাংশ পাকিস্তানি নারী-পুরুষ বলেছেন, তাদের প্রিয় পোশাক নেকাব। সমীক্ষায় থাকা দেশগুলো ছিল- তিউনিশিয়া, পাকিস্তান, মিশর, ইরাক, লেবানন, সৌদি আরব এবং তুরস্ক। ওই সমীক্ষা রিপোর্টে বলা হয়, ইরান, ইরাক ও লেবাননে এই পোশাকের চল রয়েছে।
এতে হাত ও মুখের কিছু অংশ খোলা থাকে। তবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে যে পোশাকটি রয়েছে, সেখানে মাথায় স্কার্ফ ধরনের এবং লম্বা পোশাকের সঙ্গে পুরো মুখাবয়ব খোলা থাকে। মিশরের নারীদের ৫২ শতাংশ এটি পরেন। রিপোর্ট বলেছে, বর্তমান মুসলিম বিশ্বের নারীরা সব থেকে আধুনিক হিসেবে এই পোশাকটিকেই বেছে নিয়েছেন। বিশেষ করে ইরান ও তুরস্কের আধুনিক নারীরা এই পোশাক পছন্দ করছেন। এর সঙ্গে আরো একটি স্টাইল রয়েছে। সেটি হলো, হাল ফ্যাশনের রঙিন লম্বা ধরনের পোশাক, কিন্তু মাথায় বড় মাপের ওড়না দিয়ে মাথা শিথিলভাবে মোড়ানো। আর ৬ নম্বরের পাশ্চাত্য রীতির মিশেলে সালোয়ার কামিজসহ যেকোনো ধরনের পোশাক।
এদিকে মুসলিম নারীদের এই সর্বাধুনিক হিজাব ফ্যাশনকে গুরুত্ব দিয়ে তৈরি নানা মাত্রার হিজাব তৈরি করছেন ফ্যাশন হাউজগুলো। তাদের তৈরি বাহারী ডিজাইনের নানা মাত্রিকতার হিজাব বিক্রি হচ্ছে ধুমছে।