পৃথিবীতে ভালোবাসার অনন্য নিদর্শন হিসেবে প্রায় চারশ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে ভারতের উত্তর প্রদেশের আগ্রা’র ঐতিহাসিক তাজমহল।
এর সৌন্দর্যে আজো সারা বিশ্বের প্রেমিকের চোখ তৃপ্ত হয়।তাজমহল নিয়ে অনেক গল্প ও কল্পকাহিনী প্রচলিত রয়েছে। তবে এসবের বেশিরভাগেরই যথাযথ প্রমাণ না থাকলেও কাহিনীগুলো বহু বছর ধরে মানুষের মুখে মুখে রটে বেড়াচ্ছে।
মোগল সম্রাটদের মধ্যে শাহজাহান ছিলেন বেশ বিলাসী। আকর্ষণীয় স্থাপত্যের প্রতি তাঁর শুধু ঝোঁকই ছিল না। বরং তা রীতিমতো এক নেশায় পরিণত হয়েছিল। ফলস্বরূপ, শাহজাহান খ্যাত হয়েছিলেন prince of builders’ নামে। ইতিহাসের ধূসর পাতা সাক্ষ্য দেয়, তাজমহল নির্মাণের এই বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয় ১৬৩২ সালের শুরুতে।
সম্রাট শাহজাহান ও মমতাজের প্রেম কাহিনীতে বলা হয়েছে --সম্রাট শাহজাহান মমতাজকে বাজারে দেখতে পান। ১৪ বছরের ইরানী কিশোরী মমতাজের সৌন্দর্য শাহজাহানকে বিমোহিত করেছিল। প্রথম দেখাতেই শাহজাহান মমতাজকে পছন্দ করে ফেলেন। কিন্তু এও শোনা যায় শাহজাহানের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার আগেও মমতাজের বিয়ে হয়েছিল। সম্রাট শাহজাহান মমতাজের সেই স্বামীকে হত্যা করে তারপর মমতাজকে বিয়ে করেছিলেন।মমতাজকে বিয়ে করার পরও সম্রাট শাহজাহান আরও তিনটি বিয়ে করেন।তবে শাহজাহান যে মমতাজকেই অন্য সবার চেয়ে অধিকতর বেশি ভালোবাসতেন, এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
মাত্র ১৯ বছরের দাম্পত্য জীবনে মমতাজের কোলজুড়ে আসে ১৪ সন্তান। তাঁর মৃত্যুও হয় ১৪তম সন্তান প্রসবের সময়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে। ১৬৩১ সালে মমতাজ মহলের অকালপ্রয়াণে বেশ ভেঙে পড়েন শাহজাহান।আমৃত্যু সেই শোকের ছায়া দেখা যেতো তাঁর বিষণ্ন চাহনিতে।
শিক্ষনীয় গল্প : এক শরীরে দুই প্রাণ!। Educational Story in English 2022
তাজমহল নির্মাণের নকশা করেছিলেন পারস্যদেশীয় স্থপতি ওস্তাদ ঈসা মোহাম্মদ । তিনি তার স্ত্রীকে উপহার দেয়ার জন্য একটি ভাস্কর্য বানান। পরে সম্রাট শাহজাহানের পছন্দ হওয়ায় সেই ভাস্কর্যের আদলেই বানানো হয় বিশ্ববিখ্যাত তাজমহল। পরবর্তীতে সেই ব্যক্তিটির চোখ নষ্ট করে দেয়া হয় যাতে তিনি নতুন করে আর এই নকশা তৈরি করতে না পারেন। কথিত আছে, যে বিশ হাজার শ্রমিক দিন রাত খেটে এই মহলটি তৈরি করেছিলেন তাদের হাতও কেটে দিয়েছিলেন সম্রাট শাহজাহান।শাহজাহান তাজমহলের জন্য আগ্রা শহরের দক্ষিণে যমুনা নদীর তীরে একটি জায়গা নির্বাচন করেন। এই জায়গাটির মালিক ছিলেন মহারাজা জয় সিংহ । শাহজাহান তাঁকে আগ্রা শহরের মাঝখানে একটি বিশাল প্রাসাদ দেওয়ার বদলে জমিটি অধিগ্রহণ করেন। তাজমহল নির্মাণ নির্মাণকারীদের কাছে ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ।।তাজমহল নির্মানের জন্য কারিগরদেরকে আনা হয় মধ্য এশিয়া ও ইরান থেকে। ওস্তাদ আহমেদ লাহোরি ছিলেন তাজমহলের মূল স্থপতি।
তাজমহল নির্মানের জন্য প্রয়োজনীয় মার্বেল পাথর ও অন্যান্য মালপত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রায় ১৫ কিলোমিটার ঢালু পথ নির্মাণ করা হয়। পাথর বহনের জন্য এক বিশেষ ধরনের গরুর গাড়ির সাথে ২০-৩০টি ষাঁড় বেঁধে দেওয়া হতো। কপিকল এর সাহায্যে সেই পাথর ওপরে ওঠানো হত। তাজমহলের ভিত ও সমাধি নির্মাণ করতে প্রায় ১২ বছর সময় লেগেছিল। বাকি সম্পূর্ণ কাজ করতে আরো ১০ বছর সময় লাগে।
তাজমহলের গঠনে ফরাসি, অটোমান, ভারতীয় এবং ইসলামিক স্থাপত্যরীতি একসঙ্গে ফুটে উঠেছে। চিন, তিব্বত ও শ্রীলঙ্কা থেকে ২৮ রকমের বিশেষ মূল্যবান পাথর অর্ডার দিয়ে আনানো হয়েছিল। এখানেই শেষ নয়। বাগদাদ, বুখারা, সমরকন্দ এবং তুরস্ক থেকে কারিগররা এসে রাজস্থানের মাকরানার খনি থেকে মার্বেল পাথরের ওপর খোদাই করে এই স্থাপত্য নির্মাণ করেছিলেন।
ইন্দো ইসলামিক স্থাপত্য গুলির মধ্যে সবচেয়ে বৃহৎ স্থাপত্য হলো তাজমহল। তাজমহলের নির্মাণশৈলি এতটাই নিখুঁত ও সৌন্দর্যময় যা সকল স্থাপত্য থেকে এটিকে আলাদা করে তুলেছে।ভোরের আলোয় এক হালকা গোলাপীর মূর্ছনায় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে তাজমহল।রোদের আলোয় তাজমহলের দেখা মেলে এক রূপে।সন্ধ্যার গোধূলিলগ্নেই হয়তো আবার অন্য কোনো মায়াবিনী রূপে হাজির হয় সে। চাঁদনি রাতে হালকা নীল রঙের আভায় এক মনোমুগ্ধকর রূপ নেয়। এই পরিবর্তনগুলোই তাজমহলকে দিয়েছে অনন্য এক বৈচিত্র্য।